একখণ্ড মেঘ এবং ভালোবাসা

‘এই, এই! লুনা, দেখ সেই ছেলেটা।’ বহ্নি আগ্রহের সাথে তার বান্ধবীকে দেখালো একটা ছেলেকে।
ওরা শামসুন্নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী।
তখন শেষ বিকেল। সূর্যের ত্যাজ কমে গেছে।
হলের সামনের খোলা জায়গায় বসে ছেলে-মেয়েরা গল্প করছে। নিতান্ত যাদের রিলেশন বা কোনো ছেলে বন্ধু নেই, তারা একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা কোনো কাজে বাইরে যাচ্ছে।
লুনা আর বহ্নি পড়ছে দ্বিতীয় বর্ষে। ওরা পরস্পর রুমমেট।
এখন যাচ্ছে নিউমার্কেটের দিকে। প্রায়ই ওরা নিউমার্কেট ঘুরতে যায়।
হলের গেইট থেকে বের হতেই বহ্নির চোখে পড়লো ছেলেটা। কোন্ ছেলেটা?


‘কে?’ জানতে চাইলো লুনা।
‘মনে নেই তোর?’ আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো বহ্নি।
‘না, মানে…।’ লুনা মনে করার চেষ্টা করলো।
‘আরে, ওই যে ইথিকার…।’ বহ্নির কথা শেষ হওয়ার আগেই খলবলিয়ে উঠলো লুনা।
‘ওহ্ হো, চিনতে পেরেছি।’ বলতে লাগলো লুনা। ‘বাহ্ এ যে রাজপুত্র। আমি আর আগে দেখিনি তো! কী যেন নাম ছেলেটার?’
‘ইয়ে, রুদ্র।’ জানালো বহ্নি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইস্ কী সুন্দর না ছেলেটা?’ লুনার চোখ চকচক করে।
এগিয়ে যায় দু’জন রুদ্রের দিকে।
‘ভালো আছেন?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় বহ্নি।
রুদ্র চোখ ফিরিয়ে তাকায় বহ্নিদের দিকে।
মুখে হালকা একটা হাসি টেনে বলে-
‘জ্বি ভালো, আপনারা ভালো আছেন?’
‘হু, অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। কোনো কাজে এসেছেন বুঝি?’ জানতে চাইলো বহ্নি। তার কণ্ঠ দরদভরা।
‘না, ইয়ে মানে…।’ আমতা আমতা করতে থাকে রুদ্র।
হাসে বহ্নি আর লুনা।
মাথা চুলকানোর চেষ্টা করে রুদ্র। যেনো কিছু একটা মনে পড়ার কথা। কিন্তু মনে করতে পারছে না।
‘কোথায় ছিলেন এতোদিন?’ কথা ঘুরানোর জন্য প্রশ্ন করে বহ্নি।
‘ইয়ে, এই তো…।’ রুদ্র কিয়ার কিছু বলে না।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা একটু নিউমার্কেট যাবো তো, পরে কথা হবে আবার।’ বিদায় নেয় লুনা আর বহ্নি।
‘জ্বি আচ্ছা। স্লামালেকুম।’ বিদায় জানায় রুদ্র।

বহ্নিদের বিদায় জানিয়ে রুদ্র হলের গেইটের দিকে এগিয়ে যায়।
বুড়ো দারোয়ান এগিয়ে আসে।
‘ভালো আছেন মামা?’ জানতে চায় রুদ্রর কাছে।
‘জ্বি ভালো, আপনি ভালো আছেন?’ জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করে রুদ্র।
‘এই তো মামা। তা কী ব্যাপার?’ চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ দারোয়ান।
কিছু বলে না রুদ্র। মায়াকাড়া একটা মুচকি হাসির ঝিলিক তার ঠোঁটের কোণে।
দারোয়ানও কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে।
রুদ্র এগিয়ে গিয়ে ঢুকে যায় গেইট দিয়ে।
ওয়েটিং রুমে বসবে সে।

দুই.
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।

তিন.
রুদ্র প্রায় দুই ঘণ্টা বসে রইলো ওয়েটিং রুমে।
কিন্তু ইথিকার সাথে দেখা হলো না।
এক সময় ওয়েটিং রুমের রক্ষী এসে বললো, দরজা বন্ধ করে দেবো। কোনো কথা না বলে রুদ্র বের হয়ে আসে ওয়েটিং রুম থেকে। গেইটে তখন বৃদ্ধ দারোয়ান ছিলো না। দেখা হলো না তার সাথেও।

চার.
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।
প্রতিদিন আকাশে একটা করে নতুন সূর্য উদয় হয়। অস্ত যায় ঠিক ওই সূর্যটাই।

পাঁচ.
‘রুদ্রমামা ভালো আছেন?’ দরদভরে জানতে চায় বৃদ্ধ দারোয়ান।
কিছু না বলে রুদ্র গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ওয়েটিং রুমে বসবেন মামা?’ আবারও জানতে চায় বৃদ্ধ দারোয়ান।
রুদ্র কিছু বলে না। গেইট পেরিয়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসে।
বৃদ্ধ দারোয়ানের চোখ ছলছল করে উঠে। চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু মনের অজান্তেই বেরিয়ে আসে।
আহারে!

রুদ্র প্রতিদিন ভাবে আর আসবে না এখানে। কিন্তু তার ভাবনা বাস্তবে রূপ নেয় না। সে প্রতিদিন বিকালে আসে শামসুন্নাহার হলে।
দারোয়ানের সাথে দু’ একটা কথা হয়। ওয়েটিং রুমে কাটে কিছু সময়। তারপর চলে যায়।
কোনো কোনো দিন লুনা, বহ্নি বা এরকম কারো কারো সাথে দেখা হয়। কথা হয় এক তরফা।
কিন্তু ইথিকা আসে না কোনো দিন।
রুদ্র কাঁদতে চেষ্টা করে। পারে না।
ইথিকা এতো নিষ্ঠুর কেমন করে হলো?
কেমন করে ইথিকা রুদ্রকে না দেখে থাকতে পারে?
ইথিকা, কেন তুমি এতো অভিমানী?
রুদ্রর জন্ম কি তোমার জন্য হয়নি? তবে কেন তুমি ওকে এতো কষ্ট দিচ্ছ?
ইথিকা আসে না কোনো দিন, একবারও না।
তাই প্রশ্নগুলোর জবাবও জানা হয় না।
রুদ্র মন খারাপ করে, অভিমান করে, কষ্ট পায়।

এমনি করে আরও হয়তো অনেক অনেক দিন চলতো। কিন্তু চলে না। থেমে যায়। একদিন আর রুদ্র আসে না। বৃদ্ধ দারোয়ান অপেক্ষা করে করে কান্ত হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় যখন তার ডিউটি শেষ হয়, সে আরও ঘণ্টাখানিক অপো করে, এই বুঝি রুদ্রমামা এলেন। কিন্তু রুদ্র আর আসে না।
মাঝে মাঝে বিকালের কমলা রঙের রোদ দেখতে লুনাকে ফাঁকি দিয়ে বহ্নি এবং বহ্নিকে ফাঁকি দিয়ে লুনা রুম থেকে বের হয়ে আসে কোনো এক শান্ত পাগল প্রেমিক রুদ্রকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু দেখতে পায় না কোথাও। লুনা কিংবা বহ্নি বা আরও কেউ কেউ হয়তো নিজের ভুলেই মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলে। আহা!

ছয়.
বছর পাঁচ পরের কথা।
বহ্নির এক দূর সম্পর্কের মামা পাগল হওয়ায় পাবনা পাগলা গারদে ভর্তি করানো হয়েছে।
ঢাকা থেকে ওর মামিসহ আরও অনেকে গাড়ি ভরতি করে দেখতে গেছে মামাকে। বহ্নিও গিয়েছে সেই সাথে।
সেখানেই রুদ্রর সাথে দেখা হলো বহ্নির শেষবারের মতো।
ওয়েটিং রুমে বসেছিলো রুদ্র। ওর পাশে একজন রোগামতো মহিলা। মহিলার চেহারার সাথে রুদ্রর খুব মিল।
সুদর্শন রুদ্রর এখন কঙ্কালসার অবস্থা।
এগিয়ে গেলো বহ্নি আর ওর এক মামাতো বোন। অন্য সবাই তখন মামাকে নিয়ে ব্যস্ত।
‘রুদ্রকে আমি চিনি।’ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো বহ্নি।
বহ্নির দিকে ফিরে তাকিয়ে মহিলা চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।
‘ও কতদিন যাবৎ এখানে?’ জানতে চাইলো বহ্নি।
‘প্রায় চার বছর। মাঝে মাঝে বাসায় নিয়ে যাই। কিন্তু তখন কোনো কিছু খাওয়াতে পারি না। আর…’ মহিলা কথা শেষ করতে পারলেন না। ঢুকরে কেঁদে উঠলেন।
বহ্নিরা আরও কিছুক্ষণ ওখানে বসে থেকে চুপচাপ চলে আসলো।

‘তিথি, তোকে এই ছেলেটার সম্পর্কে বলেছিলাম। মনে আছে?’ বহ্নি তার মামাতো বোনকে জিজ্ঞেস করলো।
‘হু, ওই যে ইথিকা নামে একটা মেয়ের সাথে অ্যাফেয়ার ছিলো, সেই ছেলেটা না?’ বললো তিথি।
‘কী যে ভালোবাসতো ওরা একজন আর একজনকে, তুই তো দেখিসনি তাই ভাবতেও পারবি না।’ স্মৃতি রোমন্থন করছে বহ্নি।
‘বহ্নি, ওকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ জানালো তিথি।
‘মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানিস? মনে হয়, ইথিকা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বেচারা রুদ্রটা মরতেও পারছে না আবার বাঁচতেও পারছে না।’ বহ্নির চোখ জলে টলমল করছে।

4 Responses

  1. Nice thinking. Go ahead…

  2. চমৎকার হয়েছে। তোমার এই ধরণের গল্পগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ইথিকার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব…

  3. সুন্দর গল্প। লিখে যান।

  4. আমার ব্লগে আপনার কমেন্ট দেখে খুব ভালো লাগলো… thanks…

tintob এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল